ফুটবল জগতে বর্তমান সময়ে মেসি-নেইমার, কিংবা অতীত সময়ে পেলে-ম্যারাদোনাসহ, নিজ দেশের হয়ে ফুটবল খেলেছেন অনেকেই। দেশের বিশ্বকাপ জিতেছে পেলে-ম্যারদোনা। আর ফুটবল বিশ্বে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে মেসি-নেইমার-রোনালদোরা আজ নিজ নিজ দেশের সূর্য সন্তান, ফুটবলের প্রতিক। তাদের মধ্যে সেরা কে তা নিয়ে বিতর্কে জড়াচ্ছেন অনেকে, তাদের ভিতর আপনি নিজেও। কিন্তু নিজের দেশকে স্বাধীন করার জন্য ফুটবল খেলতে দেখেছেন কাউকে? অবাক হচ্ছেন?  তবে আটঘত বেধে তৈরি হন আরও অবাক হওয়ার জন্য। যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য ফুটবল খেলেছেন, সেই সূর্য সন্তানরা আর কেউ নয়। তারা আপনার, আমার দেশের সন্তান, এবং খেলেছিলেন নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্য।

সেই সময়টা ১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শোষণ আর নিপীড়নে দিশেহারা হয়ে পরে বাঙ্গালি জাতি। নিপীড়িত এই জাতিকে পথ দেখান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। বাঙালিকে শেখান প্রতিবাদের ভাষা, আর স্বপ্ন দেখান স্বাধীনতার।

৭ মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দেন ঐতিহাসিক এক ভাষণ। সে ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রতিবাদ শুরু করে বাঙ্গালি জাতি। সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে এক যুদ্ধে, যে যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার, যে যুদ্ধ ছিল মুক্তির যুদ্ধ।

স্বাধীনতার সে যুদ্ধে বাঙ্গালীর সশস্ত্র অংশগ্রহণ ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল নিজ নিজ অবস্থান থেকে। কেউ সশস্ত্র অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, খাবার দিয়ে সাহায্য করেছিলো, কেউ আবার দেশে না থেকেও মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে, বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তানিদের হিংস্রতা তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের অংশ হয়েছিলেন।

আজকে একটি ফুটবল দলের গল্প শোনাবো যারা দেশের স্বাধীনতায় জন্য ফুটবল খেলেছিলো।  বিশ্বেরি ইতিহাসে যা কখনও ঘটেনি, তেমনি বিস্ময়কর এক নজির স্থাপন করেন বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ফুটবল খেলায় অংশ নেয় দলটি। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধকালীন প্রথম ফুটবল দল এটি।

১৯৭১ সালের জুন মাস। কয়েকজন ফুটবল খেলোয়ারকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কথা উল্লেখ করে মুজিবনগর গিয়ে তাতে যোগ দিতে বলা হয়। এসময় মুজিবনগরে প্রথমে গিয়ে উপস্থিত হন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, সাইদুর রহমান প্যাটেল, শেখ আশরাফ আলীসহ আলী ইমাম এবং অন্যরা।

এরপর সেখান থেকে আকাশবাণীতে (কলকাতা রেডিও) ঘোষণা দেয়া হলো বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত খেলোয়াড়দের মুজিবনগরে রিপোর্ট করার জন্য। ঘোষণার পরে ৪০ জন খেলোয়াড় মুজিবনগর ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখান থেকে ৩০ জন বাছাই করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করা হয়। পরে আরো একজনকে অন্তর্ভুক্ত করলে সদস্য সংখ্যা ৩১ হয়। সে দল ২৩ জুলাই মুজিবনগর থেকে নদিয়া পৌঁছে।

নদিয়ার ডিসি দীপককানত্ম ঘোষ এবং স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য কর্মকর্তারা দলটিকে অভ্যর্থনা জানান। পরদিন কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে নদিয়া একাদশের বিপক্ষে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল প্রথম খেলতে নামে।   এই দিন মেহেরপুর সীমান্ত এলাকা দিয়ে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ম্যাচ উপভোগ করতে স্টেডিয়ামে আসে। খেলা শুরুর আগে জাতীয় পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করেন দলের সদস্যরা। এ সময় জাতীয় সঙ্গীতও বাজানো হয়। ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়। স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে প্রথম গোল করেন শাহজাহান। স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর দায়ে পরদিন নদিয়ার ডিসিকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ রচনা করে এক নতুন ইতিহাস। বিশ্ববাসী অবাক চোখে দেখে এক অন্যরকম ফুটবল দল। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কোন ফুটবল দল মুক্তিকামী নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য, একটি স্বাধীন পতাকার জন্য ফুটবল মাঠে দাপিয়ে বেড়ায়।

এরপর একে একে ষোলটি খেলায় অংশ নেয় দলটি। এর মাঝে ৯টিতে জয়, ৪টিতে পরাজয় এবং ৩টিতে ড্র করে। বাংলাদেশের কাছে ফলাফল মোটেও মূখ্য ছিল না। মূখ্য ছিল স্বাধীন দেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরা, বিশ্বকে নিজেদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার জানান দেয়া। তাদের উদ্দেশ্য পূরণে দলটি সম্পূর্ণ সফলও হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফুটবল খেলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সর্বমোট পাঁচ লাখ টাকা জোগাড়ে সমর্থ হন তারা।

সর্বশেষ ম্যাচে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল অংশগ্রহণ করে মোহনবাগানের খ্যাতনামা ফুটবলার গোস্টপালের নামে গড়া একাদশের বিপক্ষে। খেলাটি অনুষ্ঠিত হয় মুম্বাইয়ে যেখানে বিপক্ষ দলের নেতৃত্বে ছিলেন ভারতের খ্যাতনামা সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক নবাব মনসুর আলি খান পাতৌদি। এছাড়াও মুঘলে আজম খ্যাত দিলীপ কুমার খেলাটি দেখতে এসছিলেন এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে এক লাখ রুপি অনুদান দেন।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলঃ

১) জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক),

২) প্রতাপ শঙ্কর হাজরা (সহ-অধিনায়ক),

৩) আলী ইমাম,

৪) অমলেশ সেন,

৫) আইনুল হক,

৬)শেখ আশরাফ আলী,

৭) বিমল কর,

৮) শাহজাহান আলম,

৯) মনসুর আলী লালু,

১০) কাজী সালাউদ্দিন,

১১) এনায়াতুর রহমান,

১২) কেএন নওশেরুজ্জামান,

১৩) সুভাষ সাহা,

১৪) ফজলে হোসাইন খোকন,

১৫) আবুল হাকিম,

১৬) তসলিম উদ্দিন শেখ,

১৭)  আমিনুল ইসলাম,

১৮) আবদুল মমিন জোয়ারদার,

১৯) মনিরুজ্জামান পেয়ারা,

২০) মো. আবদুস সাত্তার,

২১) প্রাণগোবিন্দ কু-ু,

২২) মুজিবর রহমান,

২৩) মেজর জেনারেল (অব.) খন্দকার নুরুন্নবী,

২৪) লুৎফর রহমান,

২৫) অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি,

২৬) সনজিত কুমার দে,

২৭) মাহমুদুর রশিদ,

২৮) সাইদুর রহমান প্যাটেল,

২৯) দেওয়ান মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন,

৩০) মো. মোজাম্মেল হক,

৩১) বীরেন দাস বীরু,

৩২) আবদুল খালেক

৩৩) নিহার কান্তি দাস প্রমুখ,

৩৪) মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ।

ম্যানেজার : তানভীর মাজহার তান্না,

কোচ : ননী বসাক।