
সাকিব আল হাসান তখন সবে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছে। প্রথম দু-তিন মাসে মানিয়ে নেয়ার ব্যাপার তো ছিলোই, সাথে ছিলো নতুন-পুরাতন সংক্রান্ত সমস্যা। মানে পুরনোরাই বেশি মনোযোগ পেত কোচের। সাকিব প্রথম দেড় মাস ব্যাটিং অনুশীলনেরই সুযোগ পায়নি! (সাকিবের তখনকার পরিচয় ছিল মূলত বোলার হিসেবে) তাই একদিন জেদ করে কোচকে বলেই ফেললো-স্যার আমি ব্যাট করব।
কোচ কী করলেন অনুমান করুন তো-সেই বিশাল মাঠটার পাশে সাকিবকে কানেধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন, যেখানে বিকেএসপির ছোট-বড় সবাই অনুশীলন করছে। কিছুদিন বাদে আসল বিভিন্ন ক্লাবের খেলোয়াড় বাছাই কার্যক্রম। বিকেএসপির সবাই বাসে করে আসত ঢাকা আবাহনী মাঠে। সেখান থেকে ক্লাবগুলো তাদেরকে দলে টানতো। সাকিবকে কে নেবে?সাকিব তো খেলার সুযোগই পায়নি। তারপরও ভাগ্য ভাল, একটা দলে স্ট্যান্ডবাই হিসেবে টিকে গেল সে।
মানে তার কোন দরকার দলের নেই যতক্ষণ না দলের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন সাকিব কলেজে (সেটাকে বিকেএসপির সবাই কলেজই বলে তবে সাকিব তখনো স্কুলছাত্র) ক্লাস থেকে ফিরে ডাইনিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে,তখনো খাওয়া হয়নি, গায়ে ইউনিফর্ম – খোলা হয়নি – খেয়ে গিয়ে খুলে চোখে-মুখে একটু জলের ছিটে দিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার মাঠে যেতে হবে সবার আগে। তাহলে যদি মেলে একটু বেশি অনুশীলনের সুযোগ।কিন্তু কিছুই হলো না।
একটা লোক এসে সাকিবকে বললো – ‘রেডি হ।তুই যার স্ট্যান্ড বাই সে ইনজুরড।’ খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে সাকিব ছুটল। বলতে পারেন লোকটা কে ছিলো? জীবন-নাটকে কখন কে যে কার কাছে খলনায়ক হয় আবার নায়ক সেজে বসে বলা মুশকিল। এতক্ষণকার সেই খলনায়কটি সুযোগ পেয়েই নায়কের মসনদে বসে পড়লো। হ্যাঁ, লোকটা আর কেউ নন – সেই কোচ – ব্যাটিং অনুশীলন করতে চাওয়ায় সাকিবকে যে কানেধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।
সাকিবের ভাষায় এই সুযোগটাই ছিল তার খেলোয়াড়ি জীবনের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট। কেন, সেটার প্রকাশ একটু পরেই ঘটুক। টুর্নামেন্টের শুরু। টুর্নামেন্ট কোথায় হচ্ছিল? এই যে এসে গেল রাজেন্দ্র কলেজের মাঠ। টুর্নামেন্টটা হচ্ছিল রাজেন্দ্র কলেজের মাঠে।মাটির উইকেটের ওপর ম্যাট পেতে সেখানে সেকেন্ড ডিভিশন এবং এই ধরনের অন্যান্য খেলা হয়। ফুটবলও হয়। আসলে ওটা একটা ফুটবল মাঠই, চার কোনা আয়তাকারই, আবার বর্গাকারও হওয়া অসম্ভব না, তার মধ্যে ছোট ছোট লাল পতাকা মাটিতে পুঁতে গোলাকার একটা রূপ দিয়ে হয় ক্রিকেট।
সাকিবের দলের প্রথম খেলা।স্বাভাবিকভাবেই দলে সুযোগ পেল না সাকিব একদমই নতুন বলে। খেলাটায় বড় ধরনের পরাজয় হল। বড় পরাজয়ের কারণেই হয়তো সাক্ষাৎ পরের খেলায়ই এসে গেল সাকিবের সুযোগ। এখন আসছি এটাই কেনো সাকিবের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট বা পেশাদার ক্রিকেটার হবার পথে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এটাই ছিল সেই জায়গা যেখানে ভাল করতে পারলে সুযোগ মিলবে বিকেএসপি বয়স ভিত্তিক দলগুলোতে ঢোকার।
আর ওই দলগুলোতে মিলবে আরো একটু ভাল কোচ, প্রশিক্ষণ, বিদেশে খেলতে যাওয়া মানে এককথায় জাতীয় দলের পাইপ লাইনে থাকা। কিন্তু ভাল তো খেলতে হবে,নজর তো কাড়তে হবে। কিন্তু সে কি পারবে – যে ডিউস বল বা ক্রিকেট বল দিয়ে করা নিজের প্রথম বলেই বোল্ড করে উইকেট পেয়েছিল – সে কি পারবে?নাকি বাংলাদেশের আশার ফুল, হয়তো এদেশের সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান আশরাফুলের সাক্ষী হওয়া সেই ঘটনা ঘটাবে। সাকিবের তখন কিছু নামডাক হয়েছে, তবে তখনো জাতীয় দলে ঢোকেনি, আশরাফুল সেসময় জাতীয় দলের তারকা।
সাকিবের কথা সে শুনেছে, তাই মাঠের পাশে বসে প্রথমবারের মত ওর ব্যাটিং দেখছিল। ওমা!মাত্রই নেমেছে সাকিব। প্রথম বলের মুখোমুখি।বোল্ড! কিন্তু নো বল! পরের বল। স্লিপে ক্যাচ! কিন্তু মিস! ভাই এরপরের বলটা একটু ভেবেচিন্তে খেল,ঠেকা। হ্যাহ,মারতে গিয়ে স্ট্যাম্প উড়ে গেল ! এ আবার কেমন ব্যাটসম্যান আশরাফুল হাসতে হাসতে ভেবেছিল; যে এমন সে কি পারবে?পেরেছিল সাকিব! বাহান্ন বলে একশ দুই রান!
ঝড়ো বটে! কিশোর একটা ছেলে কী ইনিংসই না খেললো! তাও আবার প্রথমবারের মতো এমন জায়গায় খেলতে এসে! সন্দেহ হতে পারে মাঠ ছোট – সীমানা ছোট – মারলেই ছয় হয় – তাদেরকে এতটুকু নিশ্চিত করা যায়, এখনকার টি-টোয়েন্টির সীমানার চেয়ে বেশি ছোট হবে না।শুরুতে কিছু উইকেট পড়ায় সাকিবকে আগেই নামতে হয়েছে। বোধহয় চারে।
